পৃথিবীর ভাষাসমূহের মধ্যে আধুনিক এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষা বাংলা। ভাষা-গবেষকগণ মনে করেন, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এ ভাষার বয়স কমপক্ষে হাজার বছর। কালের পরিক্রমায় নানা উত্থান-পতন ও গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে ভাষাটি বিকশিত হয়েছে। সাধারণভাবে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক–এই তিন যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসকে বিভক্ত করা হয়।
বিভিন্ন বহিরাগত জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব ও সংস্পর্শে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। এ-কারণে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে আরবি, ফারসি, পর্তুগিজ, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষার শব্দ। এছাড়া আছে স্থানীয় ভাষাসমূহের অনিবার্য প্রভাব। আর তাই বাংলার সঙ্গে মিশে গেছে সাঁওতাল, ওঁরাও, কোচ, রাজবংশী প্রভৃতি ভাষার শব্দ। প্রাচীন, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের বাংলায় অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বাক্য-সংগঠন ও ব্যাকরণে কোনো মৌলিক ব্যবধান পরিলক্ষিত হয় না।
চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন। মধ্যযুগের সাহিত্য হিসেবে বিখ্যাত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্যসমূহ, বৈষ্ণব পদাবলি ও প্রণয়মূলক উপাখ্যান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কালে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির আধিপত্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বড় ধরনের রূপান্তরের মুখোমুখি হয়। এ-সময় বাংলা ভাষা ও মুদ্রণ-সংস্কৃতির জোরালো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মৌখিক ও পুথিপত্রের স্তর ছেড়ে বাংলা উঠে আসে লিখন ও মুদ্রণের স্তরে। লিখিত ও মুদ্রিত হতে থাকে পাঠ্যপুস্তক ও সাহিত্য।
বর্তমান বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। সরকারি দাপ্তরিক কাজের ভাষাও প্রধানত বাংলা। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলা ব্যবহৃত হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বাংলা প্রথম ভাষা। আসাম রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভাষা বাংলা। বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজ্যগুলোসহ বর্তমানে ৩০ কোটির অধিক মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ঐতিহাসিকভাবে বাংলা লড়াই ও সংগ্রামের ভাষা। এ-ভাষাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত হন তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালি ছাত্রগণ। একারণেই ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণার প্রধান কেন্দ্র। আমাদের প্রত্যাশা এই কেন্দ্র আরও প্রসারিত ও বিস্তৃত হবে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কবিতা, নাটক, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ প্রতিটি রূপ ও রীতিরই সাহিত্যধারা গড়ে উঠেছে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিসূত্রে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতি বৈশ্বিক স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা হয়ে থাকে। তবে তা প্রধানত দক্ষিণ-এশিয়া অধ্যয়নের সূত্রে। অথচ বাংলাবিদ্যা স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখার অস্তিত্ব দাবি করে।
বর্তমানে বাংলাভাষী জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং একইসঙ্গে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে বাংলা ভাষায় মানববিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। মানববিদ্যা ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিদ্যায়তনিক চর্চায় বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হলেও গবেষকদের নির্ভর করতে হচ্ছে গবেষণা-জার্নালের মুদ্রিত সংস্করণের উপর। অথচ পরিবর্তিত যোগাযোগ ব্যবস্থায় আজ জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও গবেষণা-প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবর্তন করেছে ই-জার্নাল বা বৈদ্যুতিন গবেষণা-পত্রিকার। পৃথিবীর খ্যাতিমান গবেষক, আবিষ্কারক ও পণ্ডিতগণ ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় ই-জার্নালে তাদের লেখা প্রকাশ করছেন এবং সেসব ই-জার্নাল বিশ্বব্যাপী সমাদৃতও হচ্ছে। বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা প্রকাশ করছি ই-জার্নাল বিশ্ববাংলাবীক্ষণ। এই গবেষণা-জার্নালের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের গবেষণাক্ষেত্র প্রস্তুতকরণ ও বিনির্মাণ। আমরা অনুসরণ করতে চাই সাম্প্রতিক কালের গবেষণাতত্ত্ব ও পদ্ধতি; সচেষ্ট থাকতে চাই সামাজিক বিজ্ঞান এবং ডিজিটাল হিম্যানিটিজের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায়। আমাদের উদ্যোগে স্বাগত জানাই বিশ্বের সকল বাংলাবিদ্যা বিষয়ক গবেষক ও পাঠককে।